সাক্ষাৎকারের গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

সাক্ষাৎকারের গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

সাক্ষাৎকারের গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যমূহ

ভূমিকা: সমাজকর্মে সাক্ষাৎকার বা Interview এবটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির তথ্য ছাড়া ও তার সমস্যার অনুধ্যান এবং সমস্যা সমাধানে করণীয় এবং তাকে সমাজে তার ভূমিকা পালনে সক্ষম করে তোলার জন্য সাক্ষাৎকার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এটি একটি কলা, একটি দক্ষ প্রক্রিয়ায় মাধ্যমে দুজন ব্যক্তির মধ্যে যোগাযোগ প্রথা পেশাগত কথোপকথনের মধ্য দিয়ে সাধিত হয়।

সাক্ষাৎকারের গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য


সাক্ষাৎকারের গুরুত্ব/প্রয়োজনীয়তা

নিচে সাক্ষাৎকারের কয়েকটি প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হলো:

প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ-সুবিধা তুলে ধরা: একজন সাহায্যার্থী একটি প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক কিছু আশা করতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রদান করা প্রয়োজন। একটি প্রতিষ্ঠান থেকে সাহায্যার্থী কোন কোন সেবা নিতে পারবে। সে সেবা কি বস্তুগত বা অবস্থাগত আরো সামগ্রিক সব কিছু উপস্থাপনের একমাত্র সফল পথ হলো সাক্ষাৎকার। সুতরাং এক্ষেত্রে সাক্ষাৎকারের গুরুত্ব অনেক।

সম্পর্ক স্থাপন: সাহায্যার্থীর সমস্যা নিরূপণ করার পর তার সমাধান করার সর্বপ্রথম পদ্ধতি হলো পেশাগত সম্পর্ক স্থাপন করা। যদি সাহায্যার্থী ও সমাজকর্মীর মধ্যে পেশাগত সম্পর্ক স্থাপন করা না হয় তবে সে ক্ষেত্রে সাহায্যার্থীর সমস্যা সমাধানে এগোনো অসম্ভব হয়ে পড়বে। সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে ব্যক্তির সাথে সমাজকর্মীর সমযোজন স্থাপিত হওয়ার একমাত্র প্রধান মাধ্যম। এর মাধ্যমে একে অপরের জানা শোনার সুযোগ তৈরি হয়। আর সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে এভাবেই ব্যক্তির সাথে সমাজকর্মীর পেশাগত সম্পর্ক তৈরি হয়।

তথ্য সংগ্রহ: সাক্ষাৎকার ছাড়া একজন সাহায্যার্থীর - মনোসামাজিক তথ্য সংগ্রহ করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। একটা ব্যক্তিকে অনুধাবন করার জন্য তার সমস্যা জানার জন্য তার নিজের সম্পর্কে কোন তথ্য জানার জন্য সাক্ষাৎকারের বিকল্প নেই। সুতরাং তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রেও সাক্ষাৎকারের অবদান শীর্ষে।

সাহায্যার্থীকে দায়িত্ববোধ্য করে তোলা : সমস্যাগ্রস্ত লোক প্রায়ই ভাবে যে এ সমস্যা থেকে বেঁচে উঠতে তার কোন দায়িত্ব নেই। সে মনে করে সমাজকর্মীর সাহায্য এ সমস্যা সমাধানে যথেষ্ট। সে ক্ষেত্রে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে একজন সাহায্যার্থীকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তোলা যায়। একজন অসচেতন সাহায্যার্থীকে তার নিজ দায়িত্বে সচেতন করে তোলার জন্য তার সাথে খোলামেলা কথা বলার প্রয়োজন। আর তা সম্ভব হয় শুধুমাত্র সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে।

মানসিক বিশ্লেষণ: একজন সাহায্যার্থীর মানসিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ভালভাবে জানতে হলে প্রয়োজন তার সাথে কথাবার্তা বলা। তারা শারীরিক মানসিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করা, তার আচার-আচরণ বিশ্লেষণ করা ইত্যাদি আর এসব কিছু বিশ্লেষণ করা যায় শুধুমাত্র সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে। সুতরাং একজন সাহায্যার্থীর মানসিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া যাচাই বাচাই করার জন্যও সাক্ষাৎকারের প্রয়োজনীয়তা ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ।

সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ: একজন সাহায্যার্থীর সাথে মুক্তভাবে সরাসরি মিলিত হয়ে তার সাথে আলাপ আলোচনা বা মতামত প্রকাশ করলে তার সুপ্ত প্রতিভা বিকাশ পায়। একজন সাহায্যার্থী সমস্যাগ্রস্থ হলেও তার নিকট সুপ্ত প্রতিভা থাকতে পারে। আর তার সুপ্ত প্রতিভাকে বিকাশ করার জন্য প্রয়োজন পড়ে তার সাথে সরাসরি মিলিত হওয়া, কথাবার্তা বলা আর এগুলো সম্ভব শুধুমাত্র সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে।

মূল্যায়ন: একজন সাহায্যার্থীর সমস্যা সমাধানের সফলতা কতটুকু তা মূল্যায়ন করা যায় শুধুমাত্র সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে। পরবর্তীতে সমাজকর্মী একজন সাহায্যার্থীর মধ্যে দেশপ্রেম, সামাজিক সচেতনতা, মূল্যবোধ, আত্মনির্ভরশীলতা ইত্যাদি পরিমাপ করতে পারেন

সাক্ষাৎকারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ

সমাজকর্মে সাক্ষাৎকারের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে। সেগুলো নিম্নরূপ:

১. তথ্য সংগ্রহ: সাক্ষাৎকারের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মক্কেলের সমস্যায় সামগ্রিক দিক ও সমাধানের সম্ভাব্য উপায় সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা।

২. তথ্য প্রদান: সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ ছাড়াও সমাজকর্মী তার প্রতিনিধিত্বকারী এজেন্সির উদ্দেশ্য, আদর্শ, সামর্থ্য ও সাহায্যের ধরন প্রভৃতি বিষয়ে মক্কেলকে তথ্য প্রদান করে। ৩. সাহায্য প্রদান: সাহায্য প্রদান করা সাক্ষাৎকারের আরেকটি প্রধান উদ্দেশ্য। কারণ সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি, দল ও সমষ্টিকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দানের উদ্দেশ্যেই তথ্যসংগ্রহ করা হয়।

৪. পেশাগত সম্পর্ক স্থাপন: সমাজকর্মে মক্কেল ও কর্মীর মধ্যে পেশাগত সম্পর্ক স্থাপন করা সাক্ষাৎকারের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ায় সফলতা বহুলাংশে নির্ভর কয়ে মক্কেল কর্মীর পেশাগত সম্পর্কের ওপর।

৫. সাহায্যার্থীর ক্ষমতা পরিমাপ: সাক্ষাতে সরাসরি আলোচনা ও পেশাগত সম্পর্কের প্রেক্ষিতে সমাজকর্মী সামাজিক ভূমিকা পালন ও সামাজিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টিতে মক্কেলের ক্ষমতা পরিমাপে সক্ষম হন।

৬. সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ায় সহায়তা দান: সমাজকর্মে সাক্ষাৎকারের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মক্কেলকে তার সমস্যা সমাধানে সহায়তা করা। সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে সমাজকর্মী মক্কেলের কাছাকাছি আসার সুযোগ পায়। ফলে প্রত্যক্ষভাবে মক্কেলকে উপদেশ প্রদান করা অর্থাৎ সমস্যা সমাধান সমাজকর্মীর পক্ষে সহজ হয়।

৭. দায়িত্ব সচেতন: সাহায্যার্থীকে দায়িত্ব সচেতন করে তোলা সাক্ষাৎকারের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য। এর মাধ্যমে সমস্যার প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটন করা সহজ হয়। এছাড়া ব্যক্তি সচেতন হওয়ার ফলে সাক্ষাৎকার দিতে আগ্রহী হয়।

৮. প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ: সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে সমাজকর্মী প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য, কার্যক্রম ইত্যাদি সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির নিকট ব্যাখ্যা করেন। তা না হলে প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ব্যক্তির মনে ভ্রান্ত ধারণা থেকে যায়। এর ফলে প্রতিষ্ঠানের ওপর সাহায্যার্থীর বিশ্বাস স্থাপন হয় এবং প্রতিষ্ঠানও সাহায্যার্থীর সমস্যা সমাধানে দ্রুত ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

৯. সামর্থ্যের বিকাশ: সাহায্যার্থীর শক্তি সামর্থ্যের বিকাশ সাধন সমস্যা সমাধানকে ত্বরান্বিত করে। তাই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে সাহায্যার্থীর শক্তি সামর্থ্যের বিকাশ ঘটানো যায়।

১০. মানসিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া: সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে সাহায্যার্থীর আচার-আচরণ ও মানসিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সরাসরি পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে সমস্যার অন্তর্নিহিত তথ্যাবলি আবিষ্কার করা সম্ভব।

১১. সমাধান পদ্ধতি: সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার সফলতা, ব্যর্থতা, পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা প্রভৃতি মূল্যায়ন করে থাকেন।

১২. ঘটনাবলির তথ্যসংগ্রহ: সাহায্যার্থীর ইতিবাচক দিকগুলো সততা, আদর্শ, মূল্যবোধ, আচরণ প্রভৃতি জানা একান্ত জরুরি। সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে এসব ঘটনাবলির সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করা যায়।

১৩. অনুভূতি ও প্রত্যক্ষণ ক্ষমতা: সাক্ষাৎকারের আরেকটি উদ্দেশ্য হলো অনুভূতি ও প্রত্যক্ষণ ক্ষমতাকে যাচাই করা। এর মাধ্যমে ব্যক্তি সম্পর্কে বাস্তব উপযোগী তথ্য পাওয়া যায়। ১৪. খাপ খাওয়ানো: সাহায্যার্থীকে তার পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য বিধানে সহায়তা করা সাক্ষাৎকারের অন্যতম উদ্দেশ্য। সমাজকর্মী সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তথ্যসংগ্রহ করে তাকে পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে তৎপর হয়।

১৫. বিবিধ:  সাক্ষাৎকারের অন্যান্য লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো পরিকল্পনা ও কর্মসূচি প্রণয়ন, নতুন যাচাই করা, পর্যবেক্ষণের সুযোগ প্রদান, সমস্যার প্রকৃত চিত্র জানা, আত্মবিশ্বাস গঠন, পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ, মানসিক যন্ত্রণার অবসান ঘটানো প্রভৃতি। 

উপসংহার: সুতরাং সব কিছু পর্যালোচনা করে কথা বলা যায় যে, সাহায্যার্থীর সমস্যা সমাধানে সাক্ষাৎকারের গুরুত্ব অত্যধিক। সাক্ষাৎকার ছাড়া একজন সমাজকর্মী একজন সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি সম্পর্কে কখনোই ভালভাবে জানবে না। তার মানসিক অবস্থা, তার প্রতিভা, তার মধ্যে দেশপ্রেম, সামাজিক মূল্যবোধ এবং সামাজিক সচেতনতা কতটুকু সেটাও জানা সম্ভব হবে না সাক্ষাৎকার ছাড়া। সুতরাং এর গুরুত্ব অতুলনীয়।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post